আজ সেপ্টেম্বর এর ৯ তারিখ। এক বছর আগে এই দিনে যুক্তরাষ্ট্র নামক এই বিশাল ভুখন্ডে আমার প্রথম পদার্পণ। একটা বছর কেটে গেছে বিশ্বাসই হতে চায়না। অনেক ঘটনাবহুল একটা বছর, অনেক অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের, নিজেকে নতুন করে চেনার, বার বার পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর একটা বছর...আমা্র ফ্লাইট ছিল আট তারিখ, ভোর চারটায়, কাতার এয়ারওয়েয এ । দিনগুলো কেমন জানি স্বপ্নের মত মনে হয়, যেন অনন্তকাল আগে ঘটে যাওয়া অন্য কারও কথা ...... অথচ তার পরে থেকে প্রতিটা মুহূর্ত স্পষ্ট মনে আছে। বিকেলে ল্যাবে প্রিয় মুখগুলোর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিউ মার্কেটে টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনে খালার বাসায় নানীর সাথে দেখা করতে যাওয়া, একটু কি আভাস পেয়েছিলাম, সেটাই যে শেষ দেখা......যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে বিদায় জানাতে আসা পাগল পাগল বন্ধুগুলোর সঙ্গ, মামা আর আম্মুর সাথে এয়ারপোর্ট যাওয়া, আর সবশেষে আম্মুটাকে একবার মাত্র জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দিয়ে হাসি হাসি মুখে ইমিগ্রেশনের দিকে হাঁটা দেয়া......
আমার প্রথম গন্তব্যস্থল নেব্রাস্কার রাজধানী লিঙ্কন। কাতারে বিরতি ছিল মাত্র দেড় ঘণ্টার, সব কাজ শেষ করে একেবারে শেষ মুহূর্তে প্লেনে উঠলাম, আমার সাথে একই প্লেন এ আসা বাচ্চাকাচ্চা সহ এক দম্পত্তি প্রায় মিস করতে বসেছিল পরের প্লেনটা, এত কম সময়ে বাচ্চাদের নিয়ে এতো এতো চেকিং পার হয়ে আসা বেশ দুষ্করই বটে। এর পরে শিকাগো তে যেতে বিরক্তিকর ১৪ ঘন্টা প্লেন জার্নি । শিকাগোতে ইমিগ্রেশনের দীর্ঘ লাইন পার হয়ে অবশেষে ডেস্কের ওপাশের ভদ্রমহিলা সুন্দর একটুকরো হাসি দিয়ে আমাকে অফিশিয়ালি যুক্তরাষ্ট্রে স্বাগতম জানালো । এর পরে যে প্লেনটা ধরতে হবে সেটা হল এদের ডোমেস্টিক ঘরানার প্লেন। এবং ডোমেস্টিক প্লেনগুলো যে যন্ত্রণার অপর নাম সেটাও প্রথম দিনই বুঝে গেলাম, এরা আমাকে যেতে দিবে কিন্তু আমার ব্যাগ দুটোর জন্য লাগবে বিশেষ ট্যাগ, যা আমাকে ৬০ ডলার দিয়ে কিনতে হবে। কাউন্টারের অপর পাশের মেয়েটাকে যখন সাথের ১০০ ডলারের নোটটা দিলাম, দেখে ভাব করল যেন এই নোট জীবনে প্রথম দেখছে! তারপরে কোন রকমে মানি এক্সচেঞ্জার থেকে ১০০ ডলার ভাঙ্গিয়ে লাগেজ ট্যাগ লাগিয়ে প্লেন এ উঠলাম। সন্ধ্যার সময়ে পোঁছলাম লিঙ্কন, দীর্ঘ ক্লান্তিকর জার্নি শেষে তখন মোটামোটই বিশাল ঘোরের মধ্যে আছি। তার উপর লাগেজ নিতে গিয়ে দেখি আমার একটা সুটকেসের খুব করুণ দশা করে ফেলেছে, উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল মনে হয়। মেজাজটাই গেল খারাপ হয়ে।
তল্পিতল্পা নিয়ে বাইরে যাওয়ার গেটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। লম্বা মত একটা ছেলে আর হাশিখুশি একটা মেয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল আমি সাবরিনা কিনা। এই হল অ্যারন আর তার স্ত্রী এরউইনা, আমার বর্তমান ল্যাবের সবচেয়ে ভদ্র, শান্তশিষ্ট ছেলে। ওদের দেখে মনটা একটু ভাল হল। আসার আগে অনলাইনে এক গেস্টহাউস ঠিক করেছিলাম, আমাকে সেখানেই পৌঁছে দিল ওরা। রাতে বিরাট সমস্যায় পড়লাম কনভার্টার না থাকায়। একি আর আমার বাংলাদেশ, যেখানে একটু পা বাড়ালেই পাড়ার দোকানে প্রয়োজনীয় সব জিনিশের দেখা মেলে। রিসেপশনের ওদের কাছেও কোনোরকম কনভার্টার পাওয়া গেলনা। শেষ পর্যন্ত দেখি ঘরে ঝুলানো আধুনিক টিভি আর তার পেছনে আছে ইউএসবি পোর্ট, কোনমতে মোবাইলটা চালু করে ইন্টারনেট এ ঢোকা গেল। চরম ক্লান্ত থাকা স্বত্তেও এক ফোঁটা ঘুম হলনা, হবে কি করে, বাংলাদেশে যে তখন ফকফকা দুপুর বেলা ...সকালে প্রচন্ড মাথাব্যাথা নিয়ে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট খেলাম, এদের শাটল সার্ভিস আছে, মুলত এই জন্যই এই গেস্ট হাউজে থাকা, আমাকে ইউনিভার্সিটি পোঁছে দিল দুপুরের দিকে। ল্যাবে গেলাম, সুপারভাইসর এর সাথে আলাপ হল, প্ল্যান প্রোগ্রাম এসব নিয়ে, তার ল্যাব ঘুরে ঘুরে দেখালেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন কয়েকজন ল্যাবমেটের সাথে। সেই মানুষগুলো এখন প্রতিদিনের সঙ্গী। এরপরে খুঁজে খুঁজে বাসে করে গেলাম মেইন ক্যাম্পাসে, ব্যাংক এ। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আর কার্ড ছাড়া এখানে সবকিছু অচল, তারপর হন্তদন্ত হয়ে গেলাম ইন্টারন্যাশনাল স্কলার ও স্টুডেন্ট সেন্টারে মিটিং ধরতে। সেখানে সাইন ইন করে আবার ডিপার্টমেন্টে এসে অফিশিয়াল সব ডকুমেন্টে সাইন করা। ওহ! কোনমতে সব ফরমালিটিস শেষ করার পরে কিছুক্ষন ঘুরলাম ক্যাম্পাসের ভিতরে, সুন্দর জায়গা, অনেক সবুজ আর শান্ত। স্টুডেন্ট ইউনিয়নটা অবশ্য বেশ রমরমা। পছন্দ হল বেশ। পরের দিন দুপরে আমার ফ্লাইট টেক্সাস, অস্টিনে। এজন্যেই তাড়াহুড়ো করে একদিনে সব কাজ শেষ করা। মনে ভাসতে ছিল সেবার ওয়েস্টার্ন সিরিজের, র্যাঞ্ছ, প্রেইরী আর ট্রেইলের গল্পগুলো। অস্টিন যাওয়ার পথে বিরতি ছিল ডেনভারে, প্লেন উড়তে যাবার আগে পিছাতে গিয়ে লাগাল বিশাল ধাক্কা, তারপরে ১ ঘণ্টা লেট।
অস্টিন পৌঁছলাম, সেখানের কাহিনী আর ঘটনাবহুল। যে বাসা ঠিক করে এসেছিলাম সেটা পছন্দ না হওয়ায় অস্টিনের সুপারভাইজরের বাসায় ৩ রাত থাকা, নতুন ইউনিভার্সিটির নতুন ল্যাবমেটদের সাথে পরিচয়, রোদের মধ্যে হেঁটে হেঁটে নতুন বাসা খোঁজা, দেবদুত স্বরূপ নতুন কিছু বন্ধু পাওয়া, সব মিলিয়ে সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রায় ছয়মাসের মত থাকা হল সেখানে। আবার এক শীতের সন্ধ্যায় ফিরে এলাম লিঙ্কনে।
এবার আমি অনেক অভিজ্ঞ। বাসা খোঁজা, এয়ারপোর্ট থেকে আনা এসবে সাহায্য করল এক থাই ল্যাবমেট। আস্তে আস্তে পরিচয় হল ছোট্ট লিঙ্কনের হাতে গোনা বাংলাদেশীদের সাথে। সবার সাহায্য না পেলে টিকে থাকাই দায় হত। ফরটি সেভেন্থ স্ট্রীটের ছোট্ট বাসাটা নিজের মত করে সাজিয়ে নিলাম। সবসময় আমি ছিলাম ঘরকুনো টাইপ। মানুষ যে সামাজিক জীব এখানে এসে নতুন করে উপলব্ধি করলাম।