Wednesday, April 11, 2018

Llincoln

আজ সেপ্টেম্বর এর ৯ তারিখ। এক বছর আগে এই দিনে যুক্তরাষ্ট্র নামক এই বিশাল ভুখন্ডে আমার প্রথম পদার্পণ। একটা বছর কেটে গেছে বিশ্বাসই হতে চায়না। অনেক ঘটনাবহুল একটা বছর, অনেক অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের, নিজেকে নতুন করে চেনার, বার বার পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর একটা বছর...আমা্র ফ্লাইট ছিল আট তারিখ, ভোর চারটায়, কাতার এয়ারওয়েয এ । দিনগুলো কেমন জানি স্বপ্নের মত মনে হয়, যেন অনন্তকাল আগে ঘটে যাওয়া অন্য কারও কথা ...... অথচ তার পরে থেকে প্রতিটা মুহূর্ত স্পষ্ট মনে আছে। বিকেলে ল্যাবে প্রিয় মুখগুলোর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিউ মার্কেটে টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনে খালার বাসায় নানীর সাথে দেখা করতে যাওয়া, একটু কি আভাস পেয়েছিলাম, সেটাই যে শেষ দেখা......যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে বিদায় জানাতে আসা পাগল পাগল বন্ধুগুলোর সঙ্গ, মামা আর আম্মুর সাথে এয়ারপোর্ট যাওয়া, আর সবশেষে আম্মুটাকে একবার মাত্র জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দিয়ে হাসি হাসি মুখে ইমিগ্রেশনের দিকে হাঁটা দেয়া......
আমার প্রথম গন্তব্যস্থল নেব্রাস্কার রাজধানী লিঙ্কন। কাতারে বিরতি ছিল মাত্র দেড় ঘণ্টার, সব কাজ শেষ করে একেবারে শেষ মুহূর্তে প্লেনে উঠলাম, আমার সাথে একই প্লেন এ আসা বাচ্চাকাচ্চা সহ এক দম্পত্তি প্রায় মিস করতে বসেছিল পরের প্লেনটা, এত কম সময়ে বাচ্চাদের নিয়ে এতো এতো চেকিং পার হয়ে আসা বেশ দুষ্করই বটে। এর পরে শিকাগো তে যেতে বিরক্তিকর ১৪ ঘন্টা প্লেন জার্নি । শিকাগোতে ইমিগ্রেশনের দীর্ঘ লাইন পার হয়ে অবশেষে ডেস্কের ওপাশের ভদ্রমহিলা সুন্দর একটুকরো হাসি দিয়ে আমাকে অফিশিয়ালি যুক্তরাষ্ট্রে স্বাগতম জানালো । এর পরে যে প্লেনটা ধরতে হবে সেটা হল এদের ডোমেস্টিক ঘরানার প্লেন। এবং ডোমেস্টিক প্লেনগুলো যে যন্ত্রণার অপর নাম সেটাও প্রথম দিনই বুঝে গেলাম, এরা আমাকে যেতে দিবে কিন্তু আমার ব্যাগ দুটোর জন্য লাগবে বিশেষ ট্যাগ, যা আমাকে ৬০ ডলার দিয়ে কিনতে হবে। কাউন্টারের অপর পাশের মেয়েটাকে যখন সাথের ১০০ ডলারের নোটটা দিলাম, দেখে ভাব করল যেন এই নোট জীবনে প্রথম দেখছে! তারপরে কোন রকমে মানি এক্সচেঞ্জার থেকে ১০০ ডলার ভাঙ্গিয়ে লাগেজ ট্যাগ লাগিয়ে প্লেন এ উঠলাম। সন্ধ্যার সময়ে পোঁছলাম লিঙ্কন, দীর্ঘ ক্লান্তিকর জার্নি শেষে তখন মোটামোটই বিশাল ঘোরের মধ্যে আছি। তার উপর লাগেজ নিতে গিয়ে দেখি আমার একটা সুটকেসের খুব করুণ দশা করে ফেলেছে, উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল মনে হয়। মেজাজটাই গেল খারাপ হয়ে।
তল্পিতল্পা নিয়ে বাইরে যাওয়ার গেটের কাছে এসে দাঁড়ালাম। লম্বা মত একটা ছেলে আর হাশিখুশি একটা মেয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল আমি সাবরিনা কিনা। এই হল অ্যারন আর তার স্ত্রী এরউইনা, আমার বর্তমান ল্যাবের সবচেয়ে ভদ্র, শান্তশিষ্ট ছেলে। ওদের দেখে মনটা একটু ভাল হল। আসার আগে অনলাইনে এক গেস্টহাউস ঠিক করেছিলাম, আমাকে সেখানেই পৌঁছে দিল ওরা। রাতে বিরাট সমস্যায় পড়লাম কনভার্টার না থাকায়। একি আর আমার বাংলাদেশ, যেখানে একটু পা বাড়ালেই পাড়ার দোকানে প্রয়োজনীয় সব জিনিশের দেখা মেলে। রিসেপশনের ওদের কাছেও কোনোরকম কনভার্টার পাওয়া গেলনা। শেষ পর্যন্ত দেখি ঘরে ঝুলানো আধুনিক টিভি আর তার পেছনে আছে ইউএসবি পোর্ট, কোনমতে মোবাইলটা চালু করে ইন্টারনেট এ ঢোকা গেল। চরম ক্লান্ত থাকা স্বত্তেও এক ফোঁটা ঘুম হলনা, হবে কি করে, বাংলাদেশে যে তখন ফকফকা দুপুর বেলা ...সকালে প্রচন্ড মাথাব্যাথা নিয়ে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট খেলাম, এদের শাটল সার্ভিস আছে, মুলত এই জন্যই এই গেস্ট হাউজে থাকা, আমাকে ইউনিভার্সিটি পোঁছে দিল দুপুরের দিকে। ল্যাবে গেলাম, সুপারভাইসর এর সাথে আলাপ হল, প্ল্যান প্রোগ্রাম এসব নিয়ে, তার ল্যাব ঘুরে ঘুরে দেখালেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন কয়েকজন ল্যাবমেটের সাথে। সেই মানুষগুলো এখন প্রতিদিনের সঙ্গী। এরপরে খুঁজে খুঁজে বাসে করে গেলাম মেইন ক্যাম্পাসে, ব্যাংক এ। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আর কার্ড ছাড়া এখানে সবকিছু অচল, তারপর হন্তদন্ত হয়ে গেলাম ইন্টারন্যাশনাল স্কলার ও স্টুডেন্ট সেন্টারে মিটিং ধরতে। সেখানে সাইন ইন করে আবার ডিপার্টমেন্টে এসে অফিশিয়াল সব ডকুমেন্টে সাইন করা। ওহ! কোনমতে সব ফরমালিটিস শেষ করার পরে কিছুক্ষন ঘুরলাম ক্যাম্পাসের ভিতরে, সুন্দর জায়গা, অনেক সবুজ আর শান্ত। স্টুডেন্ট ইউনিয়নটা অবশ্য বেশ রমরমা। পছন্দ হল বেশ। পরের দিন দুপরে আমার ফ্লাইট টেক্সাস, অস্টিনে। এজন্যেই তাড়াহুড়ো করে একদিনে সব কাজ শেষ করা। মনে ভাসতে ছিল সেবার ওয়েস্টার্ন সিরিজের, র‍্যাঞ্ছ, প্রেইরী আর ট্রেইলের গল্পগুলো। অস্টিন যাওয়ার পথে বিরতি ছিল ডেনভারে, প্লেন উড়তে যাবার আগে পিছাতে গিয়ে লাগাল বিশাল ধাক্কা, তারপরে ১ ঘণ্টা লেট।
অস্টিন পৌঁছলাম, সেখানের কাহিনী আর ঘটনাবহুল। যে বাসা ঠিক করে এসেছিলাম সেটা পছন্দ না হওয়ায় অস্টিনের সুপারভাইজরের বাসায় ৩ রাত থাকা, নতুন ইউনিভার্সিটির নতুন ল্যাবমেটদের সাথে পরিচয়, রোদের মধ্যে হেঁটে হেঁটে নতুন বাসা খোঁজা, দেবদুত স্বরূপ নতুন কিছু বন্ধু পাওয়া, সব মিলিয়ে সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রায় ছয়মাসের মত থাকা হল সেখানে। আবার এক শীতের সন্ধ্যায় ফিরে এলাম লিঙ্কনে।
এবার আমি অনেক অভিজ্ঞ। বাসা খোঁজা, এয়ারপোর্ট থেকে আনা এসবে সাহায্য করল এক থাই ল্যাবমেট। আস্তে আস্তে পরিচয় হল ছোট্ট লিঙ্কনের হাতে গোনা বাংলাদেশীদের সাথে। সবার সাহায্য না পেলে টিকে থাকাই দায় হত। ফরটি সেভেন্থ স্ট্রীটের ছোট্ট বাসাটা নিজের মত করে সাজিয়ে নিলাম। সবসময় আমি ছিলাম ঘরকুনো টাইপ। মানুষ যে সামাজিক জীব এখানে এসে নতুন করে উপলব্ধি করলাম।

Declluttering memories Lincoln

আজকে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলাম, লিঙ্কনে সুন্দর ঠান্ডা আবহাওয়া কিন্তু চরম রোদ আর প্রচন্ড বাতাস। পুরো সকাল টা বাসায় কাটিয়ে বিকালের এই ওয়েদার আমি অবশ্য উপভোগ করছিলাম। বাস আসতে এখনো পনের মিনিট বাকি। স্ট্যান্ডে আমি ছাড়া আর এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা বসেছিলেন, সাথে অনেক তল্পিতল্পা। আন্দাজ করলাম মেক্সিকান বা দক্ষিণ আমেরিকান কোন দেশের হবেন। একটু আগে তার সঙ্গীকে দেখলাম উঠে পাশেই কোথাও যেতে। মুচকি হাসি বিনিময়ের পরে কথা শুরু হল।  মনে হয় অপেক্ষা করতে করতে  বোরড হয়ে গেসিলেন, আমাকে সঙ্গী পেয়ে অনেক কথা বলা শুরু করলেন। ভদ্রমহিলা কলম্বিয়ান, এখানে অনেক বছর ধরে আছেন। কিছুদূর কথা এগোনোর পরে বললেন, যখন এখানে এসেছি, ২৬ বছর ছিল আমার বয়স, মাত্র ৯৪ পাউন্ড ছিল ওজন অ্যান্ড আই ওয়াজ স্কিনি! ২৬ বছর বয়সী সেই ছিপছিপে তরুণীর কথা চিন্তা করে আপনা থেকেই একটা ভাল লাগা হাসি চলে এল।  তারপরে কলম্বিয়ার গল্প শুরু করলেন, এখানে শীতকালে শুধু তার একটু সমস্যা হয়, আমার হাত ধরল, বলেন কি উষ্ণ! আসলেই অনেক ঠাণ্ডা তাঁর হাত, বাইরের ঠান্ডা বাতাসের ফলাফল। কথা বলতে বলতে তাঁর সঙ্গী ফিরে আসল। বুড়োকে এদেশী মনে হল। আমার সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন, জলি বুড়ো  হেসে হাই বলে সঙ্গে সঙ্গে জিগেস করে, আমার সেলফোন টা ব্যবহার করতে পারবে কিনা। মনে মনে একটু চিন্তিত হলেও তাকে বললাম নাম্বারটা বলতে। আন্সারিং মেশিনে মেসেজ রাখল, তাঁর এক বন্ধুর কাছে যাতে ওদের কে রাইড দিতে আসে। তারপরে দেখি পকেট থেকে বিশাল এক চকলেট বের করে আমার হাতে দিচ্ছে :P, বলে এটা তোমার জন্যে। অনেক গাই গুই করলাম, যে দেখ আমি তো মোটা হয়ে যাচ্ছি আর চকলেট খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছি (লেম এক্সকিউজ ;)) এই কথা শুনে বুড়োবুড়ি এমন হো হো  হাসি দিল, আমি আর কি বলব ! তারপরে বলা শুরু করল আমার গ্র্যান্ড ডটারও ঠিক এটই বলে। যাই হোক নিলাম চকলেট, দুজনেই খুব খুশি। ওদের বললাম এস শেয়ার করি, আমাকে বলে না এটা তোমার। ঠিক আছে আমার। কি আর করা :)।  আমি জিন নিয়ে স্টাডি করি শুনে দুইজনেই মহা খুশি। বুড়োর বয়স ৯৩ বছর অ্যান্ড হি লস্ট হিজ কিডনী। এজন্যে এখন কাজ করতে পারেনা। মহিলা হছে তার ল্যান্ডলেডি। তারপরে তার গ্র্যান্ডফাদার এর গল্প শুরু করল, যে নাকি আইরিশ অরিজিন ছিল। আমাকে বুঝাল nelson আর nelsen দুই বানানের নামের অরিজিন এর ডিফারেন্স টা  কি। কথা বলতে বলতে দেখি সিগারেট ধরায়, আমি আঁতেল এর মত বললাম, তোমার কিন্তু স্মোক করাটা ঠিক হচ্ছেনা। মনে হল এটা বুড়ির ফেভারিট টপিক, সেও সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়ে বলল  বুড়ো নাকি প্রতিদিন বলে যে আজকেই ছেড়ে দিবে। কিন্তু ঐ বলা পর্যন্তই। আমাদের কথার কাছে পরাজিত হয়ে শেষ মেশ বেচারা সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে যাও তোমার জন্যে ছেঁড়ে দিলাম :P , বলে পকেট থেকে ভাপরাইজার বের করে টানা শুরু করল। আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানালাম। এর পরে সে জিজ্ঞেস করে, বল তো আমার ল্যান্ডলেডির বয়স কত? আমি বললাম ৬৫? শুনে আবার দুজনে হাসি। সে নাকি ৮০ বছর বয়সী। আরও কিছুক্ষ্ণ কথা চলল, বলতে বলতে দেখি ওদের ফ্রেন্ড যাকে ফোন করেছিল, সে চলে এসেছে। বাস ও চলে আসল একি টাইমে। বাই বলে উঠে গেলাম বাসে। সাথে থাকল ভিন্ দেশি দুই বুড়োবুড়ির স্নেহভরা সুন্দর বিকালের স্মৃতি।

Sunday, February 19, 2017

স্পন্দনগিরির পথে


ছোটবেলা থেকে অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী পড়ে পড়ে ভ্রমণ করার শখটা যে প্রায়ই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তা বিচিত্র নয়। তো সেদিন হাসিনা আপার বাসায় সবাই মিলে যখন পার্থ দা কে চেপে ধরল আমাদের কয়জনকে নিয়ে একটা Day Trip প্ল্যান করতে তখন আমিও বেশ সায় দিয়ে গেলাম। সময়টা ছিল গতবছর, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। এর  দুই দিন পরেই হঠাৎ দেখি দাদার ইমেইল, যে ৩১ তারিখ, ২০১৬ এর শেষ দিন টা আমরা ব্যস্ত না থাকলে জীবন্ত  আগ্নেয়গিরি দেখতে যেতে পারি। না না ঘাবড়াবার কিছু নেই, জীবন্ত মানে যে ওখানে গেলেই গরম লাভায় ঝলসে যাব, সেরকম নয় ব্যপারটা। এই মাঝে মাঝে একটু অগ্ন্যুৎপাত ঘটার সম্ভাবনা আছে, এটুকুই।

আমি এখন আছি লস বানোস , ফিলিপিন্সে; আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটে (IRRI) পিএইচডি র কিছু কাজ করছি। শীতের ছুটিতে সবাই মোটামোটি  দেশে গিয়েছে। আমরা এই ক'জন হাঁপিয়েই উঠেছিলাম; তাই দেখা গেল, সবাই একবাক্যে রাজি যেতে। শর্মিষ্ঠা দি সেই অনুযায়ী ১৪ সিটের  গাড়িও ভাড়া করে ফেললেন। আমরা মোট ১৫ জন, তার মধ্যে ৩ জনের বয়স আট এর নিচে, সেই হিসেবে ১৪ সিটে ভালই এঁটে যাবে সবাই। ঠিক হল, সকাল সাড়ে সাতটার দিকে গাড়ি আসবে  IRRI এর হারার হলে, তারপরে রেমুন্ডো গেটের থেকে বাকিদের নিয়ে নিবে।

কিছুটা উত্তেজনা কাজ করছিল, অনেক দিন পরে ঘুরতে যাওয়া হবে দেখে, তাও আবার আগ্নেয়গিরি।  মাঝখানের ৩ দিন চোখের পলকেই কেটে গেল। ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল বেলা যাত্রা শুরু করলাম। সবাই উঠার পরে গাড়ি চলা শুরু করল "তাল" আগ্নেয়গিরির দিকে। হ্যাঁ,  গিরির নাম তাল। এই সুযোগে গিরিটা সম্পর্কে একটু বলে নেই। বলা হয়ে থাকে, বাতাঙ্গাস প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত এই তাল গিরি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, যদিও এর ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস ভয়ঙ্কর।  লাজন দ্বীপপুঞ্জের আগ্নেয়গিরির সারির মধ্যে এটি অন্যতম। প্রায় ৫০০ হাজার বছর আগে দুইটি টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এই আগ্নেয়গিরির।  তবে এর একটি বিশেষত্ব হল, এটি একটি আগ্নেয়গিরি দিয়ে পরিবেষ্টিত লেকের মধ্যে অবস্থিত যা আবার আরেকটি বড় লেকের মধ্যে অবস্থিত। মজার ব্যপার হল, আরও গভীরভাবে যদি চিন্তা করি এই সম্পুর্ণ লেক পরিবেষ্টিত গিরি এবং আগ্নেয়দ্বীপটি কিন্তু আবার ফিলিপিনস দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে অবস্থিত যা দুর্লভ।  আসলে বিভিন্ন সময়ের অগ্ন্যুৎপাতে তাল লেক এর  সৃষ্টি হয়েছে আবার পরে লেকের ভিতরে ছোট আগ্নেয়গিরি দ্বীপটির সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর ১৬টি decade volcano র মধ্যে এটি অন্যতম।  যখন কোনো আগ্নেয়গিরি অনেকবার অগ্নুৎপাত ঘটায় এবং জনবসতির কাছাকছি হওয়াতে মানুষের ক্ষয়ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায় তাদেরকে এই decade volcano র অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  এপর্যন্ত ৩৩ বারের বেশি অগ্নুৎপাতের ইতিহাস আছে এর। মূল গিরি থেকে শেষ ভয়ঙ্কর অগ্নুৎপাত ঘটে ১৯১১ সালের দিকে আর বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পরে শেষ অগ্নুতপাতের ইতিহাস ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে। তবে এখনো  নাকি সিসমিক স্কেল এ মাঝে মাঝে বিপদসীমার উপরে চলে যায় এর কম্পনবিধি।

সেদিন আকাশে ছিল মেঘের ঘনঘটা। শেষমেষ বৃষ্টিটা  শুরুই হয়ে গেল যেতে যেতে ,গাড়ির মধ্যে সবাই হাসাহাসি করতে লাগলাম যে আমরা একসাথে কোথাও বের হলেই নাকি এরকম বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। রাস্তা বেশ ভাল, তবে চড়াই উৎরাই আছে কিছু।  প্রায়  ২ ঘন্টা লেগে গেল তালিসে শহরে পৌঁছতে। এই শহরের কাছেই তাল হ্রদ।  বৃষ্টি  তখন মোটামোটি জোরেশোরেই হচ্ছে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে লেকের পাশে অপেক্ষা করলাম কিছুক্ষন বৃষ্টি কমার জন্য। লেকের পাশে বেশ সুন্দর বাঁশের তৈরি কয়েকটি কুটির আছে, এগুলো পাশের রেঁস্তোরার অংশ, ভিতরে টেবিলও আছে বসে খাওয়ার জন্যে। পরে শুনলাম এরকম বাঁশের কুটির নাকি রেডিমেড অবস্থায় কিনতেও পাওয়া যায়।  বৃষ্টি একটু  কমলে আমরা ৩ টা ইঞ্জিন চালিত নৌকা (এদের ভাষায় বলে বাঙ্কা)  ভাড়া করে চললাম গিরির দিকে। এই নৌকাগুলো ফিলিপিন্সের বিশেষ নৌকা, আমার মনে হল এটার দুইপাশে দাঁড়ের মত সাপোর্ট থাকায় এর ভারসাম্য বেশ ভাল। অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশাল অগ্ন্যুৎপাত এই হ্রদকে সমুদ্র থেকে আলাদা করে ফেলে।  এখানে পানি প্রথমে লবনাক্ত থাকলেও এখন নাকি এটি মিঠা পানির হ্রদ হয়ে গেছে। যদিও উত্তাল বাতাসে আর বৃষ্টির বদৌলতে আমি ঠিকই টের পেলাম সেই পানির স্বাদ, আমার কাছে একটু লবনাক্তই লাগল। অদ্ভূত একটা অভিজ্ঞতা। চার পাশে বৃষ্টি,  বাতাস আর উত্তাল লেকের ঢেউ এর মাঝে দিয়ে ছুটে চলা। পথে কিছুক্ষন চালকের সাথে গল্প করলাম। কথায় কথায় জানা গেল সে আগে ম্যানিলা (ফিলিপিন্স এর রাজধানী)  তে ড্রাইভারের কাজ করত, কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে এই নৌকা চালিয়েই তার চলছে। সে আরও বয়ান করল তাল গিরির অগ্ন্যুতপাতের ইতিহাস। ১৯৬৭ সালে শেষ লাভা উদ্গীরন ঘটে এই গিরি থেকে, তার ফলে নাকি অনেক ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে আর এজন্যেই এখানে বেশির ভাগ বাড়িঘর এরকম কুটিরের মত করে বানানো। প্রায় ৩০ মিনিটের নৌকা ভ্রমন শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম তীরে। ফিলিপিন্সে একটা জিনিস খুব ভাল লাগে, এরা সব কিছু বেশ সুন্দর করে সাজাতে পছন্দ করে। এখানে নেমেই দেখলাম I Love TAAL Volcano  লেখা বিশাল বর্ণমালা সাজিয়ে রেখেছে। টুরিস্টরা মহা আনন্দে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। মনের স্মৃতির সাথে সাথে মুহূর্ত গুলোকে ক্যামেরাবন্দী করার প্রচেষ্টা। নৌকা থেকে নামার সময় কিছু ফটোগ্রাফার এর দল তুলে নেয় ছবি। ফিরে আসার সময়ে এই ছবিগুলো প্রিন্ট করে বিক্রি করার চেষ্টা করবে সবার কাছে, কেউ নিবে কেউ হয়ত নিবেনা। এই টুরিস্ট ফটোর স্ট্র‍্যাটেজি সারা বিশ্বেই বেশ  চালু ।


আমরা এগোলাম পাহাড়ে উঠার রাস্তা ধরে। পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট পাড়ার মত, গড়ে উঠেছে টুরিস্টদের খাতিরেই, যদিও এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা সরকার থেকে নিষিদ্ধ করে দেয়া। পাশেই ঘোড়ার আস্তাবল, চাইলে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়েও গিরির চূড়ায় উঠা যায়, অথবা পায়ে হেঁটে। ঘোড়াগুলোকে দেখে কেউই ঠিক ভরসা করতে পারলাম না তাই সবাই পায়ে হেঁটে উঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। পাহাড়ে উঠতে প্রথমে খুব একটা খারাপ লাগলনা, খুব খাড়া নয়। তবে একটু বালি বালি, আস্তে আস্তে চারপাশের প্রকৃতি  তার রহস্য উন্মোচন করতে থাকল। আর সেই সাথে আছে ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি। ভাগ্যিস বৃষ্টি খুব জোরে হচ্ছিলনা, না হলে হয়ত আমরা আর  উঠতেই পারতাম না। অর্ধেক রাস্তা মত উঠে একটা ছাউনি। সবাই সেখানে বসে হালকা লাঞ্চ করে নিলাম, আর সেই সাথে চলল ফটোশ্যুট। চারপাশে অনেক গুলো ছোট ছোট গিরি, কোথাও কোথাও ধোঁয়া উঠছে পাহাড়ের গা থেকে।  দূরে মেঘের মাঝে মাঝে  ভেসে উঠেছে পাহাড়ের সারি। ঘোড়ায় করে অনেক অভিযাত্রী দল উঠছে, হুট হুট শব্দ করে একটু পর পর তারা আমাদের পাশ কাটিয়ে উঠে যাচ্ছে। আবার শুরু হল পথচলা, এবার যেন একটু একটু কষ্ট হল উঠতে, মনে হয় প্রায় চূড়ার  কাছে চলে এসেছি  দেখে। পথে এখন লাল বালি আর মাটি।  খনিজ মিশে আছে, বাতাসে একটু একটু সালফারের গন্ধ, আর কিছু  গর্ত দিয়ে ধোঁয়া উঠছে। উঠে আবার একটু বিশ্রাম নেয়ার পালা। এদেশ যেন ডাবের ই দেশ, পাহাড়ের চুড়ায়  ও তার ব্যাতিক্রম নয়, দামটা যদিও দ্বিগুণ।   তাগালগ (ফিলিপিন্সের বেশ কয়েকটি ভাষার একটি ) ভাষায় একে বলে বুকো। বাচ্চারা খেলো বুকো জুস। আমরা এবার উঠলাম একদম উপরের অব্জারভেশন ডেক এ। উঠেই  অবশ্য হতবাক হয়ে গেলাম। এতক্ষন আমরা চারপাশের পুরো দৃশ্য দেখতে পারিনি, এবার যেন প্রকৃতি সবটুকুই উজাড় করে দিল।

 
দূরে লাল মাটি আর বালি দেখা যাচ্ছে, লাভা জমে নাকি এরকম গঠন হয়েছে ওখানকার মাটির। আর সামনে লেকের মধ্যে ছোট্ট আগ্নেয় দ্বীপটা । এই ছোট্ট লেকটা সালফিউরিক এসিডের সাথে বোরন, ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম এবং সোডিয়ামের লবন মিশে তৈরি। ঐ খানেও যাওয়া যায়, কিন্তু যেতে সময় লাগবে দেখে আর আমাদের নৌকার কাছে তিন ঘন্টার মধ্যে ফিরতে হবে দেখে আমরা আর যাইনি। এর মধ্যে সবাই আবার এক পশলা  ভয়ও পেয়ে গেল, রত্নার মাসীমা, যিনি শাড়ির সাথে হিল স্যান্ডেল পড়ে দিব্যি পাহাড়ে উঠেছেন, ঘোষণা দিলেন, তিনি ভুমিকম্পন টের পাচ্ছেন।  সাথে সাথে তুহিন ও সায় দিল, সেও টের পেয়েছে।  কিছুক্ষন থেকে এবার নিচে নামার পালা। কি এক অজানা কারনে মনে হল নামতে পারলে স্বস্তি। পাহাড় থেকে নামাটা যত সহজ ভেবেছিলাম ততটা সহজ হলনা। কারন মাটি একটু বালি  বালি। তারপরেও উঠার তুলনায় অনেক শীঘ্রই নেমে আসলাম। আমাদের নৌকা অপেক্ষা করছিল নিচে। একই নৌকায় ফিরলাম। এবার পুরোপুরি   ভিজে গেলাম লেকের উত্তাল ঢেউ আর নৌকার গতিতে।  এপারে এসে আবার একটু খিচুড়ি খাওয়া হল। লেকের পানি আর বৃষ্টিতে ভিজে সেই খিচুড়ি যেন অমৃতের স্বাদ দিল। সন্ধ্যা হাতে তখনও কিছু সময় বাকি ছিল দেখে আমরা ঠিক করলাম তাগাওতা শহরে যাব। প্রায় ২৫০০ ফুট উপরে মাউন্ট গঞ্জালস এর উপরে People's park in the sky নামে একটি পার্ক আছে যেখান থেকে পুরো এলাকাটা সুন্দর দেখা যায়। আগে এর নাম ছিল  "palace in the sky" । এখানে একটি আবহাওয়া কেন্দ্রও আছে।  আমরা  ধীরে ধীরে মেঘের উপরে উঠে যাচ্ছিলাম দেখে আমাদের বাচ্চা বাহিনী, অর্ঘ্য , মারজানা আর  সৃজন  খুব মজা পেয়ে  গেল।  হাত দিয়ে ধরে মেঘ খেয়ে ফেলার বিফল চেষ্টা ওদের এনার্জি বাড়িয়ে দিচ্ছিল যেন আরও। উপরে উঠে মনে হল শীতের দেশে চলে এসেছি। মেঘের জন্য কয়েক হাত দুরের বস্তুও দেখা যায়না, নিচের শহর তো দূরের কথা।  আমরা সবাই মিলে তাকিয়ে থাকি পাহাড়ের উপর থেকে। হঠাৎ করে মেঘ সরে গিয়ে চিকচিকে সোনালি রঙ এর শহর ভেসে উঠে নিচে, আবার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই  হাওয়া হয়ে যায়। এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে প্রিয়লাল দা দরদাম করে কিছু স্থানীয় কলা কিনলেন । লস বানোসে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল।  ঘটনাবহুল ২০১৬ সালকে এভাবেই বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম আমরা ১৫ জনের ছোট্ট অভিযাত্রী  দল। চারিদিকে তখন চলছে আতশবাজির খেলা, প্রস্তুতি চলছে নতুনকে বরন করে নেয়ার।

Friday, July 12, 2013

মিশরে অন্যরকম আট দিন - ৪

 ২২ শে এপ্রিল , ২০১২, এই কনফারেন্সের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা আমার মোটামোটি ভালো, সবার সাথে কথা বলে ভালো লেগেছে। এখানে আসার আগে কেমন জানি অস্থির লাগছিল, সেই অস্থিরটা কেটেছে। এখন সামনে অনেক গুলো দিন আছে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার। আমি এবার কোনও সিম কার্ড নেইনি, সেজন্যে আমার সাথে এবার ইন্টারনেটও নেই। তবে কনফারেন্স হলে সবসময়ই নেট থাকে বলে সমস্যা হয়না। রাতে ভুমধ্যসাগরের ঢেউ এর আওয়াজ শুনে শুনে ভালোই ঘুম হয়েছে। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে গেলাম। নাস্তা খাওয়ার সময় দিনের বেলা হোটেল এর অনেকগুলো ছবি তুললাম, আর সেই সাথে সাগরের। আর নতুন পাওয়া বন্ধুদের সাথেও চলল স্মৃতি ধরে রাখার উৎসব।

 হোটেল এর সকালের নাস্তাটা কমপ্লিমেন্টারি হিসাবে দেয়। বুফে সিস্টেম, অনেক কিছু থাকে। আমার কক্ষ সঙ্গী ডালিয়া খুব খাদ্য রসিক, অনেক কিছু নিয়ে খায় দেখি। আবার সাথের কিছু পাকিস্তানি মেয়ে ছিল ওরা আবার দেখি কিছুই খায়না, খুব সীমিত। আমাদের এই কনফারেন্স টা সত্যিকার অর্থেই অনেক গুলা দেশে মানুষের সমাহার, এক মেয়ের সাথে পরিচয় হল, সে তুরস্কের কিন্তু পি এইচ ডি করছে চায়না তে। হঠাত আমাদের টেবিল এ আরেকটা মেয়ে এসে বসল, কথা বলে জানা গেল সে আমাদের এখানে  ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর প্রতিনিধি হয়ে এসেছে। আজকে BIOVISION এর মূল কনফারেন্স শুরু, তাই আমাদের YOUNG SCIENTIST দের গ্রুপ ছাড়া বাকিরাও চলে আসছে। অনেক নতুন মুখ দেখলাম। নাস্তা শেষে সবাই চললাম বাস এর দিকে। বড় বড়  হলুদ রঙ এর দুইটা বাস। এরা আমাদের প্রতিদিন নিয়ে যায় আলেক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরি তে আমাদের কনফারেন্স স্পট এ   বাস এ পাশে বসল নাইজেরিয়ান ছেলে ইয়ু। কথায় কথায় ও আলাপ করছিল ওদের দেশের কথা,সেখানে পিএইচ ডি করে যেতে পারলে কাজ করার নাকি অনেক সুযোগ আছে।


যেতে যেতে চোখ পরে গেলো ডান দিকে। অসম্ভব সুন্দর ঘন নীল ভূমধ্যসাগর, গর্জন করে চলেছে। আমার মাঝে মাঝে খুব ঈর্ষা লাগে সমুদ্রের তীরের শহরবাসীদেরকে। কি সুন্দর মন খারাপ হলেই তারা চলে যেতে পারে সমুদ্রের বিশালতার কাছে। তীর ধরে হাঁটলেই তো মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা।

আমাদের বাস পৌঁছে গেছে alexandria লাইব্রেরি তে।  ঠিক করলাম আজকে কফি ব্রেকের সময় আশেপাশের জায়গাটা একটু ঘুরে দেখবো। আজকে আমাদের BVA.NXT fellow দের জন্যে বিশেষ সেশন এর শেষ দিন। বিকেল বেলা মূল conferrence শুরু হবে। আজকের সেশনগুলো কম চমকপ্রদ ছিলোনা। কফি ব্রেকএর সময় বের হলাম একটু আশেপাশে ঘুরে দেখতে। বেশি দূর গেলামনা, সেশন শুরু হয়ে যাবে। বাতাসে সমুদ্রের নোনা গন্ধ, সেই সাথে মিশে আছে কতো বছর আগের ঐতিহ্য। লাইব্রেরি এর  উলটো দিকেই alexandria ইউনিভার্সিটি। রাস্তা ঘাটে  প্রাচীন alexandria কে ধরা রাখের অনেক প্রয়াস।

ফিরে এলাম আবার conferrence এ . আমাদের সবার পোস্টার গুলো টাঙ্গানো আছে হল রুম এ। সেই সাথে রয়েছে ই- পোষ্টারিং এর ব্যবস্থা। কম্পিউটার এ যে কেও চাইলে automated presentation দেখতে পারবে পোস্টারটার, সেটা অবশ্য আমাদের তৈরি করে আগে জমা দিতে হয়েছে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম অন্য পোস্টার গুলো। Biological সাইনস এ কতো রকমের কাজ। আমার সাথে এক মেয়ে বললো সেও  salinity টলারেন্স  নিয়ে কাজ করে, মাটির , অর্থাৎ মাটির লবনাক্ততা কীভাবে কমান যায়, তা নিয়ে, তার background অবশ্য chemistry।


আজকের লাঞ্চ এর পরে আমাদের ঘুরে দেখানো হল লাইব্রেরির ভিতর টা। আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম এই টুর টা নিয়ে। লাইব্রেরি এবং এর ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের guide অনেক কিছু  বললো। ১৯৭৪ এর দিকে alexandria তে এই নতুন লাইব্রেরি টা তৈরীর প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেকটা সেই প্রাচীন লাইব্রেরি এর আদলে। উদ্দেশ্য ছিল এটি হবে আধুনিক যুগে জ্ঞান চর্চার তীর্থস্থান। এই লাইব্রেরি তে আপাতত আরব, ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ ভাষার বই  আছে। আর প্রায় আট মিলিয়ন বই রাখার মত সেলফ আছে। এখানে ৪ টি museum, ৪ টি আর্ট  gallery আছে, planitarium এবং manuscript restoration ল্যাবরেটরি ও আছে।  প্রধান রিডিং রুম টা অদ্ভুত সুন্দর আর বড়। ভালো লাগল অন্ধদের জন্যে ব্রেইল সিস্টেমের  আলাদা সেকশন আছে দেখে। এদের কাছে ইন্টারনেট archive এর একমাত্র backup থাকে জেনে রোমাঞ্চিত হলাম । Antiquity এবং  mansucript Museum গুলো ঘুরান শেষে আমাদের নিয়ে আসলো culturama section এ . এখানে অনেক বড় একটা panaromic স্ক্রীন আছে যেটা ৯ টি আলাদা ফ্ল্যাট স্ক্রীন এর সমন্বয়ে গঠিত। এখানে মিশরের ৩ টি সময়কে তুলে ধরা হয়েছে, প্রাচীন egypt থেকে শুরু করে, ইসলামিক civilization এবং শেষে মডার্ণ egypt। দেখলাম বিখ্যাত আলেক্সান্দ্রিয়া বাতিঘরের জায়গাটা। মনে হল আমিও চলে গেছি সেই প্রাচীন মিশর  এ ।




culturama শো শেষে আমরা আবার ফিরে এলাম কনফারেন্স  সেন্টার এ । মূল হল রুম এ অপেক্ষা করতে থাকলাম কখনো উদ্বোধন হবে bivision Alexandria ২০১২ এর। উদ্বোধন করলেন biobliothica alexandriar পরিচালক  ইসমাঈল serageldin। এরপরে কথা চলল আয়োজকদের Biovision এর এই  কনফারেন্স আয়োজন এর মুল উদ্দেশ্য নিয়ে। ২০১৩ তে ফ্রান্স এ পরবর্তী কনফারেন্স এর announcement হল। TWAS এবং bIOVISION  মিলে  কিভাবে উন্নয়নশীল দেশ গুলো উপকৃত হতে পারে তা নিয়ে কথা চলল।


রাতে হোটেল এ ফিরে কিছুক্ষণ ঘুরাফিরা করলাম আশেপাশে। রুমে এসে দেখি ডালিয়া বসে আছে ওর খাটে  , বললো আজকে স্পেসিয়াল কিছু খেতে ইচ্ছা করছে। ওর  কোন  arabic ফ্রেন্ড নাকি কায়রোতে থাকে যে ওকে জাফির নামে একটা রেস্তরার কথা বলেছে, যেখানে খুব ভালো সী ফুড  পাওয়া যায়। আমি চাইলে আমরা দুই জন মিলে সী ফুড খেতে জাফির এ যেতে পারি। আমার adventerous মন আনচান করে উঠল, এই সুযোগে শহরটা আরেকটু ভালো করা দেখা হবে। রেডী হয়ে নিলাম , রাতে alexandria তে ভালোই ঠান্ডা পড়ে। শালটা জড়িয়ে নিলাম গায়ে। রাস্তায় এসে খোঁজ করলাম ট্যাক্সির। বেশির ভাগি চেনেনা রেস্তরাটা।  একজন যাওবা চিনল দাম হেকে বসলো অনেক। ডালিয়া ভালো আরবীতে কথা বলতে পারে। ও ই কথা চালালো ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে। অবশেষে উঠে বসলাম ট্যাক্সি তে । কিছুক্ষণ পর  দেখি taxi driver ডালিয়াকে আমার সম্পর্কে জিগেস করছে। আমার দেশ বাংলাদেশ শুনে সে খুব খুশি, তার পরিচিত কোনো এক বন্ধু নাকি বাংলাদেশী এবং সে এরশাদের নাম ভালো মতো জানে। আর এটাও তার কাছে একটা অবাক হবার মতো বিষয় যে আমাদের দেশের প্রধান মন্ত্রী একজন মহিলা। রাতের আলেক্সান্দ্রিয়া দেখতে দেখতে চললাম। একে তো অচেনা জায়গা,  তার উপরে রাতের বেলা, ভাষাও জানিনা এদের। চললাম আল্লাহর উপর ভরসা করে।  কিছুদুর আসার পড়ে আমাদের দুইজনেরি মনে হলো আমরা ঠিক পথে যাচ্ছি তো, জাফির এতো দূরে হওয়ার কথা না। চারপাশে ডক  এর বড় বড় container. আর নির্জন বস্তি মত এলাকা।  ঘড়িতে বাজে রাত সাড়ে নয়টা। যাই হোক অবশেষে জানে পানি আসলো সমুদ্রের তীরে নিয়ন বাতিতে জ্বলজ্বল করতে থাকা জাফির লেখা দেখে। এখানে মেন্যু সিস্টেম টা মজার। বরফের মধ্যে বিভিন্ন রকমের মাছ সাজানো। যেটা পছন্দ সেটা দেখে বলে দিতে হবে। আমরা কিছু ফিস ফ্রাই আর সী ফুড স্যুপ অর্ডার করলাম ।
স্যুপটা অসম্ভব মজার ছিল, তার উপর সমুদ্রের তীরে বসে খাওয়া। এরকম অভিজ্ঞতা আড়েকবাড় হয়েছিল ফিলিপাইনে ম্যানিলা বে  এর ধারে বসে। খাওয়া শেষে মনে হচ্ছিল বুঝি উঠতে পারবোনা। ওদিকে রাত অনেক হয়ে গেছে।  ভাগ্য ভালো  বের হয়েই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। এবার অনেক তাড়াতাড়ি চলে আসলো। বুঝলাম যাওয়ার সময় ভিড় এড়ানোর জন্যে ট্যাক্সিচালক ঘুরিয়ে নিয়ে গেছিল। আর তাছাড়া one way two way রাস্তার ঝামেলা তো আছেই।  হোটেল এ পৌঁছলাম ১১ টার  দিকে রুম এ ফিরে কাত  , সারাদিনের ধকল ... কে জানে সামনের দিনে কি অপেক্ষা করে আছে ।

Sunday, January 6, 2013

মিশরে অন্যরকম আটদিন - ৩

২১ শে এপ্রিল, ২০১২ ।। দূর থেকে কে জানি আমাকে বিজাতীয় ভাষায় নাম ধরে ডাকছে। চোখ খুলতেই দেখি ঘরটা আলোয় ভেসে যাচ্ছে, আর আমার বিছানার পাশে সেই মেয়েটা সমানে আমাকে ডেকে যাচ্ছে। মনে পড়ে গেল, আমি কোথায় কি কারণে এসেছি এসব। কালকে রাতে দেরী করে ঘুমানো হয়েছে, তার উপর ছিল যাত্রার ধকল। আমি আমার কক্ষসঙ্গীর নাম মনে করার চেষ্টা করলাম। রাতে ঘুমানোর আগে কথা হয়েছে একটু। ডালিয়ার বাসা সুদানে, তবে সে দক্ষিণ আফ্রিকাতে পি এইচ ডি করছে কেমিস্ট্রিতে। আমি আমার অভ্যাসমত মোবাইলের অ্যালার্ম বন্ধ করে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ডালিয়া ডেকে না দিলে নির্ঘাত মিস করতাম আজকের অনুষ্ঠান। তাড়াতাড়ি করে রেডী হয়ে বের হয়ে আসলাম। আমাদের হোটেলের সাথে ব্রেকফাস্ট included। হোটেলের রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে নিতে হবে আর আটটার দিকে সেখান থেকে বাসে করে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হবে বিবলিওথিকা আলেকজান্দ্রিয়াতে যা নতুন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর পোশাকী নাম।

ঘর থেকে বের হয়ে দুই চোখ জুড়ায়ে গেল। দু'কদম গেলেই নীল ভূমধ্যসাগর।বড় বড় পাথরের চাই ফেলে হোটেলকে সমুদ্র থেকে সুরক্ষিত করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রেস্টুরেন্টে এসে দেখি বেশির ভাগই আমাদের এই কনফারেন্সের লোকজন। ঐখানে অনেকের সাথে পরিচয় হল। ডালিয়া আরবী স্পিকিং আর ওর ইউনিভার্সিটির আরো কয়েকজন দেখলাম আসছে। আমাকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। বেশি দেরী না করে আমরা বাসে করে রওনা দিলাম। বিবলিওথিকা আলেকজান্দ্রিয়ার আর্কিটেকচারাল সৌন্দর্য দেখার মত। গেইট দিয়ে ঢুকে বিশাল এক চত্ত্বর। তার ডান দিক দিয়ে মেইন লাইব্রেরী বিল্ডিং, সোজা গেলে প্ল্যানেটেরিয়াম আর বাম পাশে কনফারেন্স সেন্টার। আমরা সেখানে ঢুকে সবাই যার যার কনফারেন্স কিটস সংগ্রহ করলাম রেজিস্ট্রেশন বুথ থেকে। TWAS.BVA.NXT দের নিয়ে কনফারেন্সটা হবে small theater এ। যার যারে পোস্টার সেশনে পোস্টার দেয়ার কথা ছিল, তারা পোস্টার গুলো টাঙ্গিয়ে দিয়ে থিয়েটারে গিয়ে বসলাম। ঠিক সময়মত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করলেন Center for Special Studies and Programs (CSSP) এর পরিচালক মোহাম্মদ এল ফাহাম।পরিচয় করিয়ে দিলেন নতুন একটা exercise এর সাথে। প্রথমে নিজের ডান হাত উপরে তোল। এবার সেটাকে পকেটে বা ব্যাগে ঢুকাও, মোবাইল ফোন টা বের করে আন। এরপর নিজের বাম হাতটা উঁচু কর, মোবাইলের সুইচটা বন্ধ কর অথবা সাইলেন্ট কর, এবং সেটাকে পকেটে ঢোকাও। এটা যেকোন মিটিং এর জন্য আসলেই জরুরী একটা exercise। মিটিং এর মাঝখানে মোবাইল ফোনে কথা বলা একটা bad culture. 

 

TWAS এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর রোমেন মুরেঞ্জি বেশ inspiring কিছু কথা বললেন। কফি ব্রেক এর সময়ে পরিচয় হল ঘানা, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা participants দের সাথে।  কে কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসছে , কি করে এইসব আলোচনা করে সময় কেটে গেল। কফি ব্রেকের পরে সেশন টা ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলো বিজ্ঞান গবেষণায় যেসব বাঁধার সম্মুখীন হয়, তাদের অবস্থান কোথায় এবং এর থেকে বের হয়ে আসতে কি করণীয় সে সম্পর্কিত। ২৩ টি ভিন্ন দেশ থেকে এই কনফারেন্সে  বিজ্ঞানীরা অংশগ্রহণ করেছে। লাঞ্চ সারলাম  এক তিউনেশিয়ান পরিবারের সাথে। খাবার মোটামোটি ছিল, বাংলাদশি স্বাদে যদিও সেরকম মজা লাগলনা, তবে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্বাদের খাবার পরীক্ষা করতে আমার বেশ ভাল লাগে।


লাঞ্চের পরের সেশনটা খুব আকর্ষষণীয় ছিল, কিভাবে সৃজনশীলতা এবং ইনোভেশন প্রোমোট করতে হয় তার উপর। ড: রামী আজিজ এর টক বেশ মজা লাগল, তিনি বললেন কিভাবে ফুলের ছবি আঁকতে বললেই আমরা সবাই একই রকম গৎবাধা একধরণের ফুলের ছবি আঁকি। আমরা যদি ফুল আঁকা না শিখে একটা ফুল দেখে নিজে নিজে আঁকার চেষ্টা করতাম, একেকজন একেক ভাবে আঁকতাম। ছোটবেলা থেকে এভাবেই আমরা অনুকরণ করতে শিখি যা সৃজনশীলতা নষ্ট করে দেয়।  কফিব্রেকের সময়ে একটা ম্যারেজ প্রোপোজাল পেলাম নাইজেরিয়ান  এক লম্বা কৃষ্ণাঙ্গের  কাছ থেকে :P । পরিচয় হল পাকিস্তানে পি এইচ ডি রত আরেকজন বাংলাদেশী অংশগ্রহনকারীর সাথে। এর পরে ছিল ডিসকাশন  সেশন। সবাই ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা এবং সমাধান নিয়ে আলোচনা করল। অবাক হয়ে দেলাম সব দেশেই সমস্যাগুলো মোটামোটি একরকম, তার পরেও অনেক ভিন্নতা রয়েছে। যেমন নাইজেরিয়াতে পি এইচ ডি শেষ করে আসলে তার জন্য ভাল চাকুরী আছে, যা বাংলাদেশে নেই।




প্রথম দিনের মত কনফারেন্স শেষে বাসে করে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিল।অনেকক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম খালি পায়ে ভূমধ্যসাগরের তীরে। অদ্ভূত সুন্দর অনুভূতি। ফেরার পথে সমুদ্র তীরে বসে কিছুক্ষণ গল্প হল কেনিয়ান কয়েকজন ছেলের সাথে , তারা লবণ সহিষ্ণু মাছের  উপর কাজ করছে। জেনেটিকস,জেনেটিকালি মডিফা্ইড অরগানিজম নিয়ে বিতর্ক, গবেষণা  কালচার  এসব নিয়ে অনেক্ষণ কথা হল। রাতে আমি আর ডালিয়া একটু বের হয়ে KFC থেকে খেয়ে আসলাম। 

Wednesday, October 24, 2012

মিশরে অন্যরকম আটদিন - ২

২১শে এপ্রিল, ২০১২।। ইজিপ্ট এয়ার এর জন্য বসে থাকার পালা প্রায় শেষ। এর মধ্যে পরিচয় হল একজন বাংলাদেশী ভদ্রলোকের সাথে, তিনি কুয়েতে অনেক বছর ধরে ড্রাইভিং পেশায় আছেন। ফিরে যাচ্ছেন বাংলাদেশে, পরিবারের সাথে দেখা করতে। তার সাথে আরেক শিক্ষানবিশ কম বয়সী এক তরুণ, সে শ্রীলঙ্কান। গল্প হল কিছুক্ষণ এদের সাথে, এই কোথায় যাচ্ছি, কে কি করেন, কোন দেশে কিরকম লোকজন, চাকুরী কেমন এইসব নিয়ে। দুপুরে যখন এয়ারপোর্টের অতিরিক্ত ঠান্ডা এড়ানোর জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম গরমের খোঁজে, তখন তুরস্কের একটা পরিবার পাশে এসে বসল। দুই পিচ্চি আছে, একটা ছেলে, একটা মেয়ে, মহিলা বোরকা পরা। ব্যাগ থেকে রুটি বের করে মহিলা বাচ্চাগুলোকে দিল, সুইট পিচ্চি গুলোর সাথে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই চোখে মুখে খেলাধুলা করছিলাম, এইবার ঝামেলায় পড়লাম, পিচ্চি আমাকে রুটি সাধে, না করলেই গগনবিদারী কান্না শুরু করার উপক্রম করে। শেষমেষ ওদের মায়ের অনুরোধে নিতেই হল রুটি। কি আশ্চর্য এই যাত্রা, চেনা নাই, জানা নাই, সবাই একই পথের যাত্রী, বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে সবার একটাই পরিচয়, মানুষ।

অবশেষে ট্রান্সিট এর পালা শেষ হল, ইজিপ্ট এয়ার কেমন জানি মন খারাপ করা, অন্ধকার অন্ধকার, লোকজন খুব বেশি নাই। আমার সামনের সীটে বাচ্চাসহ একটা ফ্যামিলি এসে বসল। প্লেন ওড়া শুরু করতেই শুরু হল ওদের তারস্বরে কান্না। এখন চারদিকে সবাই আরবীতে কথা বলছে। অন্যরকম লাগছে সবকিছু। অথবা, আমি অনেক ক্লান্ত ছিলাম দেখে সবকিছু কেমন জানি অদ্ভূত লাগছিল। প্লেনের একমাত্র মজার জিনিস ছিল দারুন মজাদার চীজ কেক। 

আড়াই ঘন্টার মধ্যে প্লেনটা আলেকজান্দ্রিয়ার বরগ এল আরব বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল। এয়ারপোর্ট বেশি বড় না। তবে  এরপরে আমি কিছু অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার সঞ্চার করলাম। পাসপোর্ট, টিকেট চেকিং এর সময়ে কেন জানি তারা ভিসা টা কে বিশ্বাস করছিলনা, আর এরা এমন আজব উচ্চারণে ইংরেজী বলে। আমার অনেকক্ষণ লাগল বুঝতে যে  শ্রী কথাটার  মানে হল থ্রি।  এরপর আমাকে আলাদা করে এক রুমে এনে বসায়ে রাখল, এখানে নাকি একজন আছে যে ভাল ইংরেজী বলতে পারে! তার কাছে কিছুক্ষণ সবকিছু বয়ান করলাম, কি কারণে আসা, কোথায় যাব, ইত্যাদি। তার পরেও বসায়ে রাখল অনেকক্ষণ। যতই বলি বাইরে আমাকে হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ড্রাইভার থাকার কথা, তাকে ফোন কর, কানেই দেয়না। অবশেয়ে কনফারেন্স কর্তৃপক্ষকে ফোন টোন করল, কি বুঝল ওরাই জানে, প্রায় এক ঘন্টা পরে ছাড়া পেলাম এয়ারপোর্ট থেকে। অনেক সরি টরি বলল যদিও, আমি ঘুমে কিছুই মাথায় ঢোকাতে পারছিলামনা। পরে কনফারেন্স চলাকালীন সময়ে জানতে পেরেছিলাম, বরগ এল আরব দিয়ে শুধুমাত্র আমি এসেছি, বাকি সবাই কায়রো হয়ে এসেছে, এবং কারোরই এরকম কোন সমস্যা হয়নি। এর জন্য কর্তৃপক্ষ অনেক দু:খিতও ছিল।

সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আমার স্যুটকেস নিলাম।এরা আবার একজন লোক দিল সঙ্গে এসকর্ট করে নেয়ার জন্য। আচরণে বোঝা গেল তারা যথেষ্ট ক্ষমাপ্রার্থী। বাইরে বের হতেই একঝলক হালকা ঠান্ডা বাতাস মন ভাল করে দিল। সেখানে চকচকে কাল গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল ড্রাইভার। 
রাত বাজে সাড়ে বারটা। ড্রাইভার বেশ হাসিখুশী, গাড়িতে উঠে বসার পর হালকা অ্যারাবিয়ান মিউজিক ছেড়ে  দিল। প্রায় আধাঘন্টা লাগল হোটেল পৌঁছতে। এর মধ্যে রাতের আলেকজান্দ্রিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। রাতের বেলা দূরে থেকে আল ঝলমলে একটা শহর দেখতে অনেক সুন্দর লাগে। আলেকজান্দ্রিয়া ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত। অ্যারাবিয়ান মিউজিক, রাতের সৌন্দর্য আর সারাদিনের ক্লান্তি মিলিয়ে অপার্থিব একটা অনুভূতি হচ্ছিল। হোটেলে এসে পৌঁছলাম, নামার পরেই ড্রাইভার টিপস চাইল। বুঝলামনা ঠিক কত দেয়া উচিত। আসার আগে ইন্টারনেটে এদেশের লোকদের ট্যুরিস্টদের কাছ থেকে টিপস নেয়া বৃত্তান্ত পড়েছি। পরে বুঝেছিলাম প্রথম দিন তাকে একটু বেশিই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঐ রাতের বেলা বিদেশ বিভূঁয়ে এয়ারপোর্টে তাকে দেখে যে ভরসা এসেছিল, তা অমূল্য।

হোটেলের নাম 'মেডিটেরিয়ান আজুর হোটেল' । রিসেপশনে গিয়ে আমার নাম ঠিকানা এবং আসার উদ্দেশ্য বললাম, ফরমালিটিস শেষে লোকটা আমার জন্য ঠিক করে রাখা রুমের চাবি দিল আর বলল তোমার ফ্রেন্ড বোধহয় আজকে সকালেই চলে এসেছে। ডাবল রুমটা আমার মতই আরেকজন পার্টিসিপেন্টের সাথে আমার শেয়ার করতে হবে। মাথায় আবার চিন্তা ঢুকল কেমন হবে সে। হোটেলের বেয়ারা আমার ছোট্ট  স্যুটকেসটা নিয়ে গেল আমাকে রুম চিনিয়ে দিতে। হোটেলের রিসেপশন থেকে সিড়ি দিয়ে একটু নিচে নেমে তারপরে দোতলা বিল্ডিং গুলোতে রুম গুলো। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ভুমধ্যসাগরের ঢেউ আছড়ে পরার শব্দ শুনলাম। রুমে এসে দরজা খুললাম সোয়া একটার মত বাজে। রুমটা বেশ বড়, পাশাপাশি দুইটা বেড। দেখি এক বিছানা থেকে লম্বা কৃষ্ণাঙ্গ এক মেয়ে উঠে বসল, আমাকে হাই হ্যালো জাতীয় একটা কিছু বলে আবার ঘুমিয়ে গেল। আমি ওয়াশ রুমে গিয়ে গোসল টোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে ঘুম দিলাম। 

Friday, October 19, 2012

মিশরে অন্যরকম আটদিন -১

২০ এপ্রিল, ২০১২।। আমি এখন বসে আছি কুয়েত এয়ারপোর্ট এ । সময় ৯ টা বেজে ৩০ মিনিট। প্লেন ল্যান্ড করেছে ৯ টার দিকে। এখানের আমাকে ১০ ঘন্টা থাকতে হবে! ট্রান্সিট এর কাউন্টারে গেলাম খোঁজ নিতে। counter  এ বসে আছে চৈনিক চেহারার এক মেয়ে, তবে খাস চীন দেশের নাও হতে পারে। মেয়েটা আমার দিকে বেশ করুণ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল দু:খিত, তোমার আসলে যাত্রার আগেই বিশ্রামের জন্য রুমের কথা বলা দরকার ছিল, এখন আমাদের কিছু করার নাই। অতঃপর কি আর করা। আমার অভিজ্ঞতা কম, এসব ব্যপার খেয়াল ছিলনা। 

কুয়েত এর নাম ছোটবেলায় অনেক শুনতাম। আমার মেজচাচা অনেক আগে থাকতেন কুয়েতে, ফলে আব্বুআম্মুর কাছে সেখানকার বিভিন্ন গল্প শোনা হত। প্লেনটা যখন নামছিল, খেয়াল করলাম খালি খেঁজুর গাছ আর ক্যাকটাস প্রজাতির গাছ। বেশিরভাগ দেশই প্লেন ল্যান্ড করার সময় সবুজ দেখায় , কিন্তু এখানে সব হলুদ। মজার ব্যপার হল এখানে সিঁড়ি দিয়ে প্লেন থেকে নামতে হল। আমার জন্য মোটামোটি নতুন ব্যপারটা। যদিও ছোটবেলায় টিভিতে দেখতাম, প্লেন এসে থামার পরে সবাই প্লেন থেকে সিড়ি দিয়ে নামছে, বর্তমানে বেশিরভাগ এয়ারপোর্টেই তো সুড়ঙ্গের ব্যবস্থা থাকে দেখি। সে যাই হোক, এবার আমার এই ট্রিপ সম্পর্কে কিছু বলা যাক।

আমার গন্তব্যস্থল এবার মিশর। শুনলেই কেন জানি রহস্যের গন্ধে মনটা আনচান করে উঠে। মিশর আর এর মমির রহস্য কত শত গল্পই না পড়েছি এই জীবনে। এই পিরামিডে ঢুকতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলা, মমি উধাও হয়ে যাওয়া, ফারাও দের সাম্রাজ্যের কাহিনী ইত্যাদি, ইত্যাদি। আরো excited কারণ আমি প্রথম যাচ্ছি আলেকজান্দ্রিয়াতে। সেই প্রাচীন লাইব্রেরী, যেখানে প্রাচীন পৃথিবীর সকল জ্ঞান তাপস তাপসীরা জ্ঞানচর্চা করে গেছেন। আর্কিমিডিস, অ্যারিস্টটল, থিওফ্রাস্টাস, টলেমী, ক্লিওপেট্রা আরো কত কে। আমার এবার গন্তব্য ক্লিওপেট্রার ভুমি।

মিশরে কেন যাচ্ছি? Biovision Alexandria নামে একটা conference  হয়ে থাকে, আলেকজান্দ্রিয়াতে দুই বছর পর পর। গতবছর এক অলস বিকেলে ল্যাবের ডেস্ক এ বসে বসে  জীব বিজ্ঞান সংক্রান্ত কনফারেন্স এর খোঁজ করতে করতে পেয়ে গেলাম এটার হদিস। TWAS  এর সহযোগিতায় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে তরুণ বিজ্ঞানীদের নির্বাচন করে এই কনফারেন্স এ যোগ দেয়ার সুযোগ করে দেয় Biovision, সেই সাথে থাকে নিজের গবেষণা উপস্থাপন,  অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের সাথে মতবিনিময় ও নেটওয়ার্ক তৈরির সুযোগ। এই গেল মিশর যাত্রার শানে নযুল, যদিও আমার কেন জানি এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা ঠিক যে মিশরে যাচ্ছি।

যাত্রার প্রস্তুতিস্বরূপ তেমন কিছু করতে হয়নি। কনফারেন্স এর কর্তৃপক্ষ খুবই গোছানো। বিভিন্ন schedule and updates দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে। টিকেট কনফার্ম করল,  আমন্ত্রনপত্র  পাঠালো, তারপর গেলাম মিশর এম্ব্যাসি তে। সে ও এক কাহিনী। সেরকম ভীড় নাই মানুষের, মনে হয় বাংলাদেশ থেকে কি খুব কম লোক যায় ঐখানে? আমাকে প্রথমে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হল, বিরক্ত হয়ে যতবারই উঠে দাঁড়াই বিজাতীয় উচ্চারণে বলে উঠে "বোসেন, বোসেন"। পরে শুনি, এরা ঐদিনই আমাকে ভিসা ইস্যু করে দিবে বলে দেরী করছে।. তখন মনে একটু শান্তি আসল। সেই ভিসাও নরমাল একটা সীল এর মত, দেখে মনেই হয়না ভিসা। যাই হোক এখন আমার কাছে ভিসা আছে, টিকেট আছে, হোটেল বুকিং আছে, সব কাজ একা একা ঠিক করা , বুঝতে পারছিলামনা আদৌ ঠিক আছে কিনা সব কিছু। Me the last moment girl  অবশেষে যাওয়ার দিন সকালবেলা টাকা exchange করলাম। এক মিশরীয় পাউন্ড সমান ১৩ টাকা। এব্যাপারে সামসাদ জোর করে সাহায্য না করলে সময় কুলানো কষ্ট হত, security  র জন্য কিছু টাকা সাথে করে নিয়ে যাওয়া। পোস্টার টাও তড়িঘড়ি করে তৈরি করে প্রিন্ট করলাম। যাক হয়ে গেল সবকিছু। শুক্রবার ২০ এপ্রিল ভোর ৫:৩০ এ ফ্লাইট কুয়েত এয়ার এ। রিপোরটিং  ৩:৩০ এর মধ্যে। এই সময়ে এয়ারপোর্ট এ কেমনে যাব! তাই মামার সাথে বৃহস্পতিবার ১২ টায় গিয়ে বসে থাকতে হল। এয়ারপোর্টে রাত দিন কিছু নাই। মধ্যপ্রাচ্যের সব প্লেন যেখান থেকে ছাড়ে সেই লাউঞ্জে এ অপেক্ষা করতে থাকলাম। কুয়েত এয়ার এর কাউন্টার এখনো খোলেনি। আমার সামনের চেয়ারে দুইজন শয়তান শয়তান চেহারার লোক বসা, কিছুক্ষণ পর পরই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। বেশ কয়েকবার তাকানোর পরে রাগের চোটে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলবেন? থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে কোন দেশে যাবেন আপনি।  আমি আর কিছু না বলে অন্য সীটে গিয়ে বসলাম। 

রাত দেড়টার দিকে কাউন্টার খুলল। গেলাম তিন নম্বর কাউন্টারে। আরো ১৫ মিনিট পরে কাউন্টারে লোক আসল। বোর্ডিং পাস, ব্যাগেজ ট্যাগ হাতে নিয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে যাওয়ার সময়ে খেয়াল করলাম আমার ব্যাগেজ ট্যাগ এ লেখা KU থেকে Cairo. কি সর্বনাশ! সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দিলাম আবার কাউন্টারে। গিয়ে বললাম, ভাই আমি যাব আলেকজান্দ্রিয়াতে বরগ এল আরব এয়ারপোর্টে আর আপনি আমার ব্যাগ পাঠিয়ে দিচ্ছেন কায়রোতে? সেই লোক বলে, আপনি মিশরে যাবেননা? আমি বলি, হু, আলেকজান্দ্রিয়া আর কায়রো দুইটাই মিশরে কিন্তু দুইটা ভিন্ন শহর, ভিন্ন এয়ারপোর্ট, টিকেটটা দয়া করে ভাল করে পড়ে দেখেন। ভুল বুঝতে পেরে উনি সেপারেট আরেকটা ট্যাগ বানালো, কিন্তু ততক্ষণে আমার ছো্ট্ট ব্যাগটাতো চলে গেছে কার্গোতে। শুনলাম ট্যাগ বদল করে আরেকজনকে ট্যাগ টা replace  করে দিতে বলল। আমার মনে আশংকা একটু থেকেই গেল, আদৌ পাব কিনা আবার তার দেখা। একে তো ট্রান্সিট প্লেন, তার উপর আবার এই সমস্যা।

এরপর এলাম ইমিগ্রেশনে পুলিশ চেকিং এ। এই ব্যক্তি মনে হয় রাতের বেলা কাউন্টারে বসে bored feel  করছিল, অযথা প্রশ্ন করা শুরু করল, কি job  করি, কেন যাচ্ছি, family  ওখানে থাকে কিনা (?) , বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কি না, সরকারী চাকরী করি কিনা, এর আগে কোন কোন দেশে গেছি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সে সন্তুষ্ট হল কিনা জানিনা, তবে অবশেষে এর হাত থেকে রক্ষা পেলাম; আবার অপেক্ষার পালা। আমি এর আগে যত জায়গায় ট্রাভেল করেছি (যদিও খুব বেশি না), সবগুলো থেকে এটা কেমন জানি ভিন্ন। লাইনে দাঁড়িয়ে  আছি, হঠাত শুনি নিউইয়র্ক, লন্ডন, ফ্রান্কফুর্ট, আর সৌদী আরবগামী যাত্রীদের আলাদা করে ডাকা হল। আমাকে কোন category তে ফেলবে বুঝতে না পেরে বলল, যারা ফ্যামিলি সহ তারা আগায়ে আসেন। এই category  তেও আমি পরিনা দেখে অবশেষে আমাকে বলল, ম্যাডাম আপনি সামনে চলে আসেন। মাঝে মাঝে বিশেষ খাতির পেতে খারাপ লাগেনা। আবার বাধা আসল, সঙ্গের চোঙ্গা মত পোস্টার হোল্ডার দেখে। এটাকে আমার সাথে নিতে দিবেনা, ব্যাগেজ ট্যাগ এর মত উল্টোপাল্টা কিছু হওয়ার ভয়ে রাজী হলামনা। শেষমেষ এক কুয়েতী security officer এর কাছে গিয়ে তার অনুমতি নিতে হল।সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়ে থাকে এটার দিকে। খুলে দেখাতে হল এর মধ্যে বন্দুক নাই,  অবশেষে প্লেনে উঠে বসলাম, আমার পাশের সীটে  যে ভদ্রলোক এসে বসলেন, জানা গেল তিনি সৌদী আরব যাবেন, অনেক বছর যাবত ঐখানেই চাকুরী করছেন। আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষজনই এরকম যারা মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন।

অনেকক্ষণ লিখলাম, এর মধ্যে কুয়েত এয়ারপোর্ট ঘুরে শেষ করছি, খুব ছোট, ইন্টারনেট এর অবস্থা খুব ভাল না। public computer টা মনে হয় ঠিক নাই, আর free wifi   টার রেন্জ ভালনা। মাত্র ১০ টা ২০ বাজে, আরো ৯ টা ঘন্টা কিভাবে যাবে, কে জানে।